আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বই দেখছিলাম। এখনকার মতোই তখনো আমার মাথার চুল, দাড়ি ছিল বড় বড়। পরনে ছিল কোট টাই।
এক লোক আমার দিকে এগিয়ে এলো ‘মাফ করবেন ভাই, আপনি কি মুসলিম?
‘মুসলিম বলতে আপনি কী বুঝাচ্ছেন আমি জানি না। তবে আপনাকে একটা কথা বলি। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং মুহাম্মাদ g তার রাসূল। আমি উত্তর দিলাম।
তিনি বলতে গেলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে ভাই, আপনি তো মুসলিম! আমি বললাম, ও, তাই নাকি? আচ্ছা বেশ। তিনি বললেন, ‘আসেন ভাই, নামাজের সময় হয়েছে। নামাজ পড়তে যাই। তিনি আমাকে ভালোকরে দেখিয়ে দিলেন, কী করে অযু করতে হয়। আমি সবার সাথে মসজিদে জামায়াতে নামাজ পড়লাম। মসজিদে ছিল উপচে পড়া ভিড়। আমার ধারণা সে দিনটা ছিল শুক্রবার। জানেনই তো, কেবল শুক্রবারেই মসজিদ মুসল্লিতে ভর্তি থাকে।
নামাজ শেষে আমি ইমামের সাথে সবার সামনে শাহাদাহ উচ্চারণ করলাম। আমি নিচে নেমে আসতেই মুসল্লিরা সবাই আমাকে ঘিরে ধরলেন। বলতে গেলে সবাই চাইছিলেন ইসলামের খুঁটিনাটি সবকিছু পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে
পুরোপুরি বুঝিয়ে দিতে। অনেকে নামাজের নিয়মকানুন কাগজে লিখে তাদের নাম ঠিকানাসহ আমার হাতে দিয়েছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ! মানুষগুলোর আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। মসজিদ থেকে বের হয়ে আসার পর আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন গোসল করে উঠে এসেছি। আমার ভেতরটা এক স্নিগ্ধ, পবিত্র, প্রশান্ত অনুভূতিতে ভরে উঠেছিল। এই অনুভূতি এতই চমৎকার, তার সামনে মারিজুয়ানা (হেরোইনের মতোই এক ধরনের মাদক) তুচ্ছ!
মাঝেমাঝেই আমি সেই মসজিদে আসা-যাওয়া করতাম। কারণ, ওই মসজিদের সাথেই আমার পরিচয় ছিল। তা ছাড়া সেখানকার অনেক মুসল্লিই তত দিনে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।
এবার সময় হয়ে এল আমার গার্লফ্রেন্ডের মুখোমুখি হবার…
আমার বান্ধবী লন্ডনের বাইরে একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। আমি প্রায়ই তার সাথে দেখা করতে যেতাম। তার রুমে গেলে বাথরুমে ঢুকে অযু করে নিতাম। সে অবশ্য কখনো দেখেনি।
একবার আমি কিবলামুখী হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার গার্লফ্রেন্ড বিছানায় বসে বসে আমাকে দেখছিল। আমি নামাজ শেষে তার দিকে ফিরতেই, সে তীক্ষ গলায় জানতে চাইল, ‘এটা তুমি কী করলে?” ‘আমি মুসলমান হয়েছি তো, তাই নামাজ পড়ছিলাম। ‘কী…কী…’ সে চিৎকার দিয়ে উঠল ‘তুমি…তুমি কী হয়েছ? তুমি মুসলমান হয়েছ?’ সে বিরামহীন চিৎকার করে গেল। সত্যি কথা বলতে; আমার এই কথা শুনে সে খুব বেশি হতাশ এবং আহত হয়েছিল।
সেটা ছিল, আমার জীবনের এক কঠিন সময়। আমি মুসলিম ভাইবোনদের, এমনকি আমার ছেলে মেয়েদের জন্যও প্রার্থনা করি, যাতে কেউ গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে না জড়ায়। কারণ, সত্যিকারার্থে এতে জড়িয়ে খুব একটা উপকার নেই। বরং ক্ষতির দিকই বেশি। এর মাঝে উপকারিতা বলতে, পারস্পরিক সান্নিধ্য উপভোগ করা…এতটুকুই। অন্যদিকে,
এই সম্পর্কে জড়িয়ে আপনার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে, আপনার স্বাভাবিক শান্তি না হবে। আপনার স্বাভাবিক কাজকর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঈর্ষা, হ, দ্বন্দ্ব- এই সম্পর্কের সবকিছুই জীবনের জন্য, মনের জন্য যন্ত্রণাদায়ক।
আমি মনে করি, কারও যদি কাউকে ভালো লাগে, তবে নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে নেয়া উচিত। বিয়ের মাধ্যমে আপনারা একে অন্যের সাথে সহাবস্থান করতে পারবেন। একে অন্যের সাথে সুখ-দুঃখ পরস্পর ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন। আর এর মাঝেই আছে আল্লাহ পাকের রহমত ও অনুগ্রহ। যা বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে আপনি পাবেন না।
এই কথাগুলো বলছি; কারণ, আমি সে সময় ইসলামের অনুশাসন মানা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করলে, জীবনে অনেক কিছুই হারাব। বিশেষ করে আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার কাছে সে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমি তাকে অনেক ভালোবাসতাম। আমার সাথে তার সম্পর্ক আর বোঝাপড়াটাও ছিল চমৎকার। অন্তত আমি তাই মনে করতাম।
এসব বিষয় ভেবে ভেবে ইসলাম থেকে এতটাই দূরে সরে গিয়েছিলাম, আমি আর নিজেকে মুসলিম বলেও পরিচয় দিতাম না। একবার এক পার্টিতে গিয়েছিলাম। মদের আসরে কয়েক পেগ খেয়ে আমার নেশা চড়ে গিয়েছিল । বলতে গেলে আমি ছিলাম পুরোই মাতাল। এ অবস্থায়ও আমি আমার টেবিলে থাকা ৫-৬ জনকে ইসলামের কথা বলছিলাম।
জড়ানাে গলায় বলছিলাম ‘জানো, ইসলাম না অনেক সুন্দর একটা ধর্ম। তোমাদের সবারই কুরআন পড়া উচিত।
তারা বেশ আগ্রহের সাথে আমাকে বলল, “তাই নাকি? তবে আমাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে আরও কিছু বল দেখি।
আমার তখন রীতিমতো পা টলছে, ঘুরছে পুরো দুনিয়া। দেখছোনা, আমি এখন পুরোমাতাল! তোমরা নিজেরাই দেখে নিও”, বলতে বলতে টেবিলে মাথা গুঁজে আমি পড়ে গেলাম।
তখন আমার জীবন ছিল এমনই। আমি মনে মনে ইসলাম খুব ভালোভাবে বিশ্বাস করতাম কিন্তু বাস্তবে মানতে পারছিলাম না। এই যে দ্বন্দ্ব, এই যে অশান্তি, অতৃপ্তি, এর চেয়ে পীড়াদায়ক আর কিছুই হতে পারে না। আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই ভাবতাম, আজ থেকে আমি নিয়মিত নামাজ পড়ব। কিন্তু বিভিন্ন কাজে কাজে
আর পড়া হতো না। গভীর এক অবসাদ আর বিষন্নতা আমাকে পেয়ে বসেছিল। তত দিনে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথেও আমার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। আমি দিনদিন মাদকে ডুবে গিয়ে নিজেকে কৃত্রিম স্বস্তিতে রাখার চেষ্টা করছিলাম।
এভাবেই চলল দুবছর। আমার বন্ধবী তখন ছিল স্পেনে। স্প্যানিশ ভাষার উপর সে পড়াশােনা করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, তত দিনে তার সাথে অন্য এক ছেলের কিছু একটা চলছে। বুঝতে পারলেও নিজের কাছে স্বীকার করার সাহস হচ্ছিল না। তার প্রতি আমি তখনো টান অনুভব করতাম।
আমার মা-বাবা মিসর ছেড়ে পর্তুগালে চলে গেলেন। বাবা তত দিনে চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করেছেন। আমি আর এই দুর্বিষহ জীবন সইতে পারছিলাম না। তাই লন্ডন ছেড়ে মা-বাবার সাথে থাকা শুরু করলাম। কথা ছিল, আমার বান্ধবী আমার সাথে পর্তুগালে এসে দেখা করবে। কিন্তু দু সপ্তাহ ধরে তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। না কোনো ফোন, না কোনো মেসেজ।
আমার সময়টা রীতিমতো দুর্বিষহ কাটছিল।।
একদিন বাগানে আমি হাঁটছিলাম। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম, ‘এন্থনি! তুমি জানো, ইসলামই সঠিক ধর্ম। তুমি জানো, একজন মুসলিম হিসেবে তোমার পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া দরকার, অথচ তুমি পড়ছ না। সঠিক জেনেও তুমি ইসলামের অনুসরণ করছ না। তাই তো, তোমার জীবনটা আজ এতটা বিশৃঙ্খল ও এলোমেলো।
আপন মনে ভাবতে ভাবতে আমি আল্লাহর কাছে বললাম, “ইয়া আল্লাহ! আমি আর সইতে পারছি না। এমন কোনো ব্যবস্থা কর, যাতে তার ফোন পাই। কথা দিচ্ছি, আজ যদি সে আমাকে ফোন করে, তবে আজ থেকেই আমি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ব। জীবনেও আর নামাজ ছাড়ব না।
দুপুরে খাবারের পর আমি আবার বাগানে ফিরে গেলাম। এমন সময় আমার বাবা ডাক দিলেন, “এই এন্থ! তোমার ফোন। সে ফোন করেছে।
নিজের কানকেও আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বাগান থেকে, বলতে গেলে উড়ে উড়ে আমি ছুটে গেলাম ল্যান্ড ফোনের কাছে। রিসিভার কানে দিয়ে আমি হাঁপাচ্ছিলাম। মজার বিষয় হলো, সে কী বলছিল কিছুই আমার কান দিয়ে ঢুকছিল না। আমি শুধু হু হা করে যাচ্ছিলাম। আমার মাথায় কাজ করছিল, শপথ রক্ষা করে আমাকে এখন থেকে নিয়মিত নামাজ পড়তে হবে।
কথা শেষে ফোন রেখে আমি ছুটলাম বাথরুমের দিকে। গোসল সেরে দাঁড়িয়ে গেলাম নামাজে। আলহামদুলিল্লাহ, সেদিন থেকে বিনা কারণে এক ওয়াক্ত নামাজ আজ পর্যন্ত ছেড়ে দিইনি।
পরিশেষে আপনাদেরকে আমি কিছু কথা বলতে চাই। একজন মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে বড় পার্থক্য হলো নামাজ। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার মাধ্যমেই কেবল একজন মানুষ সত্যিকারে মুসলিম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ কারণেই , আমি নিজেকে সেদিন থেকে মুসলিম ভাবি, যেদিন থেকে আমি নিয়মিত নামাজ আদায় করছি। সেদিন থেকে নয়, যেদিন আমি শাহাদাহ উচ্চারণ করে মুসলিম হবার ঘোষণা দিয়েছিলাম।
আগের অংশ টুকু পড়তে[এখানে ক্লিক করুন] পরের অংশ টুকু পড়তে[এখানে ক্লিক করুন]