আলহামদুলিল্লাহ, ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসূলিল্লাহ। প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আমি আব্দুর রহিম গ্রিন। আমার ইসলাম গ্রহণের গল্পটা আপনাদের সামনে আজ তুলে ধরব।
আমার জন্ম তানজানিয়ার রাজধানী দারুস সালামে। আমার বাবা ছিলেন জাতিতে ইংরেজ, মা পোলিশ। বাবা তখন তানজানিয়াতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য! একসময় এই সাম্রাজ্য গোটা বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়ে ছিল। আর আজ? ফকল্যান্ডের সামান্য কিছু দ্বীপই কেবল ব্রিটেনের অধিকারে আছে।
সবকিছু কী দারুণভাবেই না বদলে যায়! একসময়ের বিশাল শক্তিধর রাষ্ট্রের সে শক্তিমত্তার তেমন কিছুই আর নেই। এর মাঝেই আল্লাহ আমাদের জন্য বিরাট শিক্ষা রেখেছেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন
‘তোমরা পৃথিবীতে ঘুরে দেখ। দেখ, অতীতের জাতিদের পরিণতি কী হয়েছিল যারা শক্তি সামর্থ্য সবদিক দিয়ে তোমাদের চেয়ে আরও অনেক বেশি উন্নত ছিল। সূরা আর-রূম : ৯
যাহোক, জন্মের পর আমার নাম রাখা হয় এন্থনি গ্রিন। আমার বয়স যখন দুবছর, তখন আমরা তানজানিয়া ছেড়ে যাই।
বাবার ধর্ম-কর্মে খুব একটা বিশ্বাস ছিল না। মা ছিলেন রোমান ক্যাথলিক। নিয়ম অনুযায়ী মায়ের ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী একজনকেই বিয়ে করার কথা ছিল।
যদিও মা তা করেননি। মা নিজেও খুব বেশি ধার্মিক ছিলেন না। তার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপই কিনা, মা ঠিক করলেন আমাদের দুই ভাই, আমি আর ডান কানকে ধার্মিক ক্যাথলিক বানাবেন। দশ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের একটা বোর্ডিং স্কুলে আমাকে পাঠানো হয়। স্কুলটি ক্যাথলিক ধর্মগুরুদের দ্বারা পরিচালিত ছিল।
সে স্কুলে পাঠানোর আগে মা আমাকে স্কুলের কিছু নিয়ম কানুন, কিছু প্রার্থনা শিখিয়ে দিলেন। এক রাতে মা আমাদের দুজনকে নিয়ে প্রার্থনা করলেন, হে মেরি! ঈশ্বর মাতা! তুমি আমাদের উপর তোমার পুত্র যিশুর মাধ্যমে দয়া কর। এটা ছিল ক্যাথলিকদের মধ্যে প্রচলিত বহুল ব্যবহৃত একটি প্রার্থনা।
ওই বয়সেই আমার মনে খটকা লাগল, ‘ঈশ্বরের আবার মা থাকে কী করে! ঈশ্বর তো হওয়া উচিত এমন একজন, যার কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। তাহলে তার জন্মদাত্রী মা আসে কোথা থেকে? আমার মনে হলো, যে ঈশ্বরকে জন্ম দিয়েছেন, তিনি নিশ্চয় ঈশ্বরের চেয়েও আরও অনেক অনেক বড়। সে হিসেবে মাতা মেরি তো আরও বড় খোদা।
এটা ছিল আমার মনে উদয় হওয়া প্রথম বড় জিজ্ঞাসা।
স্কুলে পড়াশোনা করতে গিয়ে আমার মনে আরও অনেক প্রশ্নের উদয় হলো । হলে একটা নিয়ম ছিল, সেখানকার ধর্মগুরুর সামনে নিজের সকল পাপ স্বীকার করতে হবে। বছরে কমপক্ষে একবার এই নিয়ম মানতেই হতো। বলা হতো, সব পাপ স্বীকার না করলে ঈশ্বর নাকি ক্ষমা করবেন না। আমার মাথায় ঢুকত না, নিজের সব পাপ এই লোকের কাছে স্বীকার করতে হবে কেন? ১২-১৩ বছরের বাচ্চাদের ওই বয়সে যদি সব পাপ স্বীকার করতে বলা হয়, তাও আবার তাদেরই আবাসিক শিক্ষকের সামনে, তারা কী আসলেই তা মানবে? আপনাদের কী মনে হয়?
আমার মনে হতো, ঈশ্বরের নাম করে পাপ স্বীকারের বিষয়টা এক ধরনের চালাকি। যাতে কোনো ছাত্রের মনে কী আছে, কে কী করে তা জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী সবাইকে টাইট দেয়া যায়। আমরাও কম যাই না। নিজের মতো করে অনেক কিছু বানিয়ে বলতাম। এই যেমন বলতাম, “গত সপ্তাহে ওই ছেলেটার দামি জামা-কাপড় দেখে আমার মনে একটু হিংসা হয়েছিল’, ‘এই সপ্তাহে আমি তিনবার মিথ্যা বলেছিলাম ইত্যাদি। এই বয়সের ছেলেরা অনেক ধরনের কাজকর্মই করে। সব কি আর অন্যের সামনে বলা যায়!
আমি একবার জিজ্ঞেসও করেছিলাম, আমাকে আপনাদের সামনেই দোষ স্বীকার করতে হবে কেন? কেন সরাসরি ঈশ্বরের কাছেই নয়? অথচ আমাদের পবিত্র বাইবেলে আছে, যিশু বলেছেন স্বর্গীয় পিতার কাছেই নিজের অপরাধ মার্জনা চেয়ে।
তারা আমাকে বললেন, “তুমি ইচ্ছে করলে সরাসরি ঈশ্বরের কাছে বলতে পার। কিন্তু তোমার নিশ্চিত হবার সুযোগ নেই, আসলেই ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করেছেন কিনা। কিন্তু আমরা ঈশ্বরের কাছে তোমাদের পাপের জন্য ক্ষমা চাইলে, ঈশ্বর অবশ্যই তোমাদের ক্ষমা করবেন।’
‘বাহ! চমৎকার! আমি বললে ঈশ্বর আমার কথা শুনবেন না কিন্তু আপনাদের কথা ঠিকই শুনবেন। অথচ আপনারা গুণে মানে কোনো দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে আহামরি ভালো কিছু নন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম। বলা বাহুল্য, তাদের এই জবাব আমাকে মোটেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
খ্রিষ্ট ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে এসেছেন। যা অবতারবাদ নামে পরিচিত। এটাও আমার ঠিক বুঝে আসত না। আমি বুঝতাম না, ঈশ্বরের মানুষ হয়ে পৃথিবীতে আসারই বা কী দরকার!
আমার এগারো বছর বয়সে বাবা চাকরি সূত্রে মিসর চলে আসেন। ছুটির দিনগুলোতে আমরা লন্ডন থেকে মিসরে চলে যেতাম। আমি ক্লাস করতাম লন্ডনে, আর ছুটি কাটাতাম মিসরে। এভাবেই কেটেছিল প্রায় দশ বছর।
আমার মনের একটা অনুভূতি আপনাদের সাথে শেয়ার করি। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমাদের শেখায়, সুখী হওয়া মানে অনেক টাকার মালিক হওয়া। কারণ, আপনার অনেক টাকা থাকলে আপনি দামি গাড়িতে চড়তে পারবেন, ড্রইং রুমে সোফায় বসে বিশাল বড় টিভি দেখতে পারবেন। ছুটির দিনগুলোতে মন ভরে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারবেন। পারবেন নিজের ইচ্ছেমতো নানা ধরনের দামি জিনিস কিনতে। তাই জীবনে সুখী হতে অনেক অনেক টাকার প্রয়োজন।
কিন্তু আসলে কি টাকা সুখ এনে দিতে পারে? সত্যি কথা হলো, অঢেল সম্পদ আপনাকে কখনোই মনের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ সুখী করতে পারবে না।
এই কথাগুলো কেন বলছি? কারণ, এই বিষয়গুলো আমাকে খুবই ভাবাত। মিসরে ফুরফুরে দিনগুলো কাটিয়ে আমি যখন বোর্ডিং স্কুলের কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যে ফিরে যেতাম; মনে হতো, কেন আমি এত কষ্ট করছি? এত কড়াকড়ির মধ্যে পড়াশোনা করে কী লাভ? কী লাভ এত কষ্ট করে, এত কিছু শিখে?
আমি ভাবতাম, আসলে এই জীবনের মানে কী? কেনই-বা পৃথিবীতে আমাদের এই বেচে থাকা? কী আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য? আমি নিজে নিজেই জবাব খুঁজে নিতাম, আমি এই স্কুলে এত কষ্ট করছি, যাতে আমার রেজাল্ট ভালো হয়। রেজাল্ট ভালো হলে আমি একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারব। ইউনিভার্সিটিতে ভালো রেজাল্ট করতে পারলে, আমার খুব ভালো বেতনের একটা চাকরি হবে। তখন আমার দারুণ একটা বউ হবে, হবে সন্তানসন্ততি। নিজের অনেক টাকা থাকলে আমার সন্তানদেরকেও ভাল ভালো স্কুলে পড়াতে পারব। যাতে তারা ভালো রেজাল্ট করে ভবিষ্যতে আমার মতোই একটা ভালো বেতনের চাকরি পায়। তখন তারাও তাদের ছেলে মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারবে, যাতে তারাও বড় হয়ে মোটা বেতনের চাকরি করে তাদের ছেলে মেয়েদের দামি স্কুলগুলোতে পড়াতে পারে।’
আপন মনেই নিজের কাছে সব কেমন যেন লাগল। ভালো করে ভেবে দেখলে,এইতো আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। এর জন্যই তো আমরা রাতদিন খাটাখাটনি করছি, এত এত কষ্ট করে মরছি…
মনে জমে থাকা হাজারও প্রশ্ন আমাকে গভীরভাবে ভাবতে শেখাল। একসময় নিজের আগ্রহে বুঝতে চাইলাম, অন্যান্য ধর্ম, অন্যান্য ধ্যান-ধারণায় জীবনের সত্যকারে মানে কী।
আমার বয়স তখন উনিশ। এই সময়ে বেশ ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা ঘটল। দশ বছরের মিসরিয় জীবনে বলতে গেলে একজন মানুষের সাথেই ধর্ম নিয়ে পরিচ্ছন্ন আলোচনা জমে উঠেছিল। যদিও ক্যাথলিক ধর্মমত নিয়ে আমার মনের ভেতর অনেক দ্বন্দ্ব ছিল; কিন্তু বাহ্যিক দিক দিয়ে কেউ আমার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করলে, তাকে হেয় করলে, আমি মনে মনে তেঁতে উঠতাম। যে করেই হোক আমি তার প্রতিবাদ করতাম।।
সেই মিসরিয় মানুষটির সাথে ধর্ম নিয়ে একদিন প্রায় চল্লিশ মিনিট আলোচনা হলো। তিনি আমাকে খুব সাধারণ কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাহলে তুমি বিশ্বাস কর, যিশুখ্রিষ্ট হলেন ঈশ্বর?
পরের অংশ টুকু পড়তে[এখানে ক্লিক করুন]