ড. মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন সালেহ আস-সুহাইম
অনুবাদক : জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের সম্পাদনা : প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সর্বোত্তম জ্ঞান শিক্ষা এবং সর্বোত্তম কাজ পালন করার মাধ্যম যেহেতু নবুওয়াত, তাই আল্লাহ তা‘আলার অশেষ রহমত যে, তিনি এ সমস্ত নবীদেরকে এমন কিছু আলামত প্রদান করেছেন যা তাদের সত্যতা প্রমাণ করে এবং মানুষেরা এর মাধ্যমে তাদের যুক্তি প্রদর্শন করে ও তাদেরকে চিনতে পারে। যদিও যে কেউই নবুওয়াত দাবী করে তার ক্ষেত্রে এমন সব লক্ষণ ও অবস্থাদি প্রকাশ পায়, যা তার সততা প্রমাণ করে, যদি সে সত্যবাদী হয়। আর তার মিথ্যা দাবী তাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে, যদি সে মিথ্যাবাদী হয়। এই সকল আলামত অনেক, তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলামত নিম্নে পেশ করছি:
১- রাসূল, তিনি শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করা এবং আর আল্লাহ ছাড়া সকল কিছুর ইবাদাত পরিত্যাগ করার আহ্বান করবেন। কারণ একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।
২- তিনি মানুষকে তাঁর প্রতি ঈমান আনতে, তাঁকে বিশ্বাস করতে এবং তাঁর রিসালাতের প্রতি আমল করার আহ্বান করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একথা বলার আদেশ করেন যে,
﴿قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا﴾ [الاعراف: ١٥٧]
“বলুন, ‘হে মানুষ! নিশ্চয় আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮]
৩- আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে নবুওয়াতের বিভিন্ন প্রকার দলীল-প্রমাণাদি দ্বারা সাহায্য করেন। এ সমস্ত প্রমাণাদির মধ্যে রয়েছে সে সব নিদর্শনসমূহ, যা নিয়ে নবী-রাসূলগণ আগমন করেন, তার স্বজাতিরা সেটা প্রতিরোধ করতে অথবা তার অনুরূপ কিছু আনতে সক্ষম হয় না। যেমন- মূসা ‘আলাইহিস সালামের নিদর্শন, যখন তার লাঠি সাপে পরিণত হয়; ঈসা ‘আলাইহিস সালামের নিদর্শন, যখন তিনি অন্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আল্লাহর হুকুমে সুস্থ করেন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিদর্শন, যথা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, এমন নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও যে, তিনি পড়তে ও লেখতে জানেন না, ইত্যাদি নবীদের অনেক নিদর্শনাবলি রয়েছে।
আর নবী ও রাসূলদের নিয়ে আসা এ নিদর্শনসমূহের অন্যতম হচ্ছে, তারা যা নিয়ে এসেছেন তা এমন স্পষ্ট ও মহা সত্য যে, শত্রুরা তাকে প্রতিহত বা অস্বীকার করার ক্ষমতা রাখে না। বরং তারা জানে যে, নবীগণ যা নিয়ে আগমন করেন তা এমন স্পষ্ট মহা সত্য যাকে প্রতিহত করা যায় না।
এ সকল নিদর্শনের অন্যতম হচ্ছে, যা আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণকে বিশেষ করে দিয়েছেন, তাদের পূর্ণ অবস্থা (বিকলাঙ্গ বা অনুরূপ কিছু না হওয়া), মহৎ গুণ এবং উদার স্বভাব-চরিত্র।
এসব নিদর্শনের অন্যতম হলো, নবী-রাসূলগণের জন্য তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য এবং তারা যেদিকে আহ্বান করেন তা প্রচার-প্রকাশ করতে সমর্থ হওয়া।
৪- প্রত্যেক নবী-রাসূলের আহ্বান, মৌলিকভাবে অপর সকল নবী ও রাসূল যে বিষয়ের দিকে আহ্বান করেছেন, সেগুলোর সাথে মিল থাকবে।
৫- তিনি কখনো তাঁর নিজের ইবাদাত-উপাসনা করা অথবা ইবাদাতের কোনো কিছু তাঁর দিকে নিবদ্ধ করা অথবা তাঁর সম্প্রদায় বা গোত্র-গোষ্ঠীর বিশেষ সম্মান করা ইত্যাদির দিকে আহ্বান করেন না। বরং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করেন, তিনি যেন মানুষকে একথা বলেন,
﴿قُل لَّآ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِي خَزَآئِنُ ٱللَّهِ وَلَآ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ وَلَآ أَقُولُ لَكُمۡ إِنِّي مَلَكٌۖ إِنۡ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰٓ إِلَيَّۚ﴾ [الانعام: ٥٠]
“(হে মুহাম্মাদ!) আপনি বলে দিন! আমি তোমাদেরকে একথা বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভাণ্ডার রয়েছে, আর আমি অদৃশ্যের কোনো জ্ঞানও রাখি না এবং আমি তোমাদেরকে এ কথাও বলি না যে, আমি একজন ফিরিশতা। আমার কাছে যা কিছু অহীরূপে পাঠানো হয়, আমি শুধুমাত্র তারই অনুসরণ করে থাকি।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫০]
৬- তিনি তাঁর দা‘ওয়াতের বিপরীতে মানুষদের কাছে পার্থিব দুনিয়ার কোনো সম্পদ তলব করেন না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী যেমন- নূহ ‘আলাইহিস সালাম, হূদ ‘আলাইহিস সালাম, সালেহ ‘আলাইহিস সালাম, লুত ‘আলাইহিস সালাম, শু‘আইব ‘আলাইহিস সালামকে সংবাদ দিতে গিয়ে বলেন যে, তারা তাদের স্বজাতিদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
﴿وَمَآ أَسَۡٔلُكُمۡ عَلَيۡهِ مِنۡ أَجۡرٍۖ إِنۡ أَجۡرِيَ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٠٩ [الشعراء : ١٠٩]
“আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না; আমার পুরষ্কার তো বিশ্বজাহানের রবের নিকটই আছে।” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪ ও ১৮০]
আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জাতিকে বলেন,
﴿قُلۡ مَآ أَسَۡٔلُكُمۡ عَلَيۡهِ مِنۡ أَجۡرٖ وَمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُتَكَلِّفِينَ ٨٦﴾ [ص : ٨٦]
“(হে মুহাম্মাদ!) আপনি বলে দিন! আমি এর জন্যে তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চাই না এবং আমি বানোয়াটদের (ভানকারীদের) অন্তর্ভুক্ত নই।” [সূরা সোয়াদ, আয়াত: ৮৬]
আর এই সমস্ত নবী ও রাসূল, যাদের সামান্য কিছু বৈশিষ্ট্য এবং তাদের নবুওয়াতের নিদর্শনাবলি আপনাদের উদ্দেশ্যে আলোচনা করলাম, তাদের সংখ্যা অনেক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ٣٦﴾ [النحل: ٣٦]
“আর নিশ্চয় আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এই আদেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং তাগুতের পূজা বর্জন করবে।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬ ]
মানুষ তাদের মাধ্যমে সৌভাগ্যবান হয়েছে এবং ইতিহাস তাদের সংবাদ লিপিবদ্ধ করে আনন্দিত হয়েছে। তাদের দীনের বিধানাবলি সন্দেহাতীত অবিচ্ছিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। আর এটাই হচ্ছে হক ও ইনসাফ। এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যে সাহায্য করেছেন এবং তাদের শত্রুদেরকে ধ্বংস করেছেন তাও বর্ণিত হয়েছে সন্দেহাতীত অবিচ্ছিন্নভাবে। যেমন- নূহ ‘আলাইহিস সালামের জাতির তুফান, ফির‘আউনের সাগরে ডুবে যাওয়া, লূত ‘আলাইহিস সালামের জাতির ‘আযাব, মুহাম্মাদ ‘আলাইহিস সালামের তাঁর শত্রুদের ওপর বিজয় লাভ এবং তাঁর দীনের প্রসার ইত্যাদি। সুতরাং যে ব্যক্তি এগুলো জানবে সে নিশ্চিতরূপে অবগত হবে যে, তারা এসেছিলেন কল্যাণ ও হিদায়াত নিয়ে এবং মানবজাতিকে সে পথপ্রদর্শন করাতে যা তাদের উপকার করবে, সাবধান করাতে সে পথ থেকে যা তাদের ক্ষতি করবে। তাদের সর্বপ্রথম হলেন নূহ ‘আলাইহিস সালাম এবং সর্বশেষ হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম।